শহর মানুষের দান, গ্রাম বিধাতার দান। এই কথাটি যেন আমার গ্রামের সাথে একদমই মিলে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানার ছতুরা শরীফ।
মানুষ ও মানুষের জীবন একটি নির্দিষ্ট তরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। মৃত্যু অবধি এ তরী থামার নয়। অনেকে অনেক সময় ভূল কিংবা অনিয়মের বসবর্তী হয়ে “জীবনের বিরতি” শব্দটা ব্যবহার করে থাকেন। যা কখনো,কোন অবস্থাতেই গ্রহনযোগ্য নয়। তবে জীবনের স্মৃতি কথাটি চিরন্তন সত্য এবং বাস্তব। তার পরও দেখি না কিছুটা অবাস্তব আর অনিয়মের বসবর্তী হয়ে জীবন যুদ্ধে একটু জিরিয়ে দেখি না ফেলে আসা সে সব স্মৃতি কতটুকু যুক্তিযুক্ত ও ফলপ্রসু ছিল। জীবনটাকে দুভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়।একটা স্মৃতি আর সময় বৃত্তিক। আপনি যদি জীবনটাকে স্মৃতি বৃত্তিক সংজ্ঞায়িত করেন দেখবেন জীবনটা অনেক দীর্ঘ। আর যখন সমকে প্রাধান্য দিয়ে যখন সংজ্ঞায়িত করবেন দেখবেন জীবন কত সংক্ষিপ্ত। আমি একথা হলপ করে বলতে পারি এই দীর্ঘ কিংবা সংক্ষিপ্ত জীবনটা সেই মজার মজার স্মৃতিতে পরিপুর্ণ করতে পেরেছে যে কিনা গ্রামের সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশে তার শৈশব অতিবাহিত করেছে। গ্রাম আর শহরের মধ্যে প্রধান পার্থক্যই হল প্রকৃতি। এই ধরুন আমাদের দেশের বিখ্যাত কবি কিংবা লেখকেরা গ্রাম এবং গ্রামের সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশকে তাদের লেখনি সিংহভাগ প্রাধান্য দিয়েছেন। আবার অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলে এই গ্রাম ছাড়া কিন্তু সাহিত্যের অস্থিত্ব খুজে পাওয়া যাবে না। ধরুন,সাহিত্য এবং সষ্কৃতি একটি গানিতিক রাশি। তাহলে দেখবেন সাহিত্য + সংষ্কৃতি = অসীম। কিন্তু এই অসীম মান থেকে যদি আপনি একটা ছোট্ট শব্দ গ্রাম বাদ দেন তাহলে দেখবেন রাশির মান শূন্যে নেমে এসেছে।
আমি আমার নিজের শৈশব সম্পর্কে এটুকু গর্ব করে বলতে পারি বেশ মজার ছিল আমার শৈশব। কারণ আমি আমার শৈশব কাটিয়েছি গ্রামের পথে-প্রান্তরে,মাঠে-ঘাটে,গাছে-বাশে।আমার বাড়ীর এমন কোন গাছ ছিল না যেটাতে আমি উঠিনি। আর আমাদের গ্রামের একটা মজার ব্যপার ছিল সব কিছুতেই ভিন্ন ভিন্ন খেলা। সব কিছু মিলে বেশ হৈ-হুল্লুড করে শৈশব কাটিয়েছি। সেখানে কোন অপ্রাপ্তি কিংবা অপরিপূর্ণতা ছিল না। কানায় কানায় পরিপূর্ণতা আর অসীম প্রাপ্তির সমন্বয়ে আমার শৈশব। তখন যদিও এসবের তেমন মূল্যবোধ বুঝতাম না। কিন্তু জীবনের এই সময়টাতে এসে পেছনে ফেলে আসা স্মৃতি মনে করতেই অকপটে ভেসে উঠে শৈশবের সময়টা।শৈশবের স্মৃতির কাছে বাকী সব।
গ্রামের সবুজ পল্লীতে যার শৈশব কাটিয়েছেন সেই ব্যক্তি যত বড়ই হোক না কেন,তার অবস্থান যেখানেই হোক সে বারেবারে চাইবে তার গ্রামের সবুজ প্রকৃতিতে ফিরে সাতে। তাইতো বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি কবিরা তাদের কবিতায় প্রকাশ করেছেন গ্রামের প্রতি তাদের আকর্ষণ-
কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত সুদূর ফ্রান্সে গিয়েও শৈশবের সেই মধুর স্মৃতি মনে করে লিখেছেন
“সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে!
সতত,তোমার কথা ভাবি এ বিরলে?”
জীবনান্দ দাশ লিখেছেন-
“আবার আসিব ফিরে,
ধানসিড়িটির তীরে,
এই বাংলায়।”
কবি আলমাহমুদের তিতাস কবিতার এই অংশটুকু প্রকাশ করে গ্রামের প্রতি তার মায়া-
জনপদে কী অধীর কোলাহল মায়াবী এ নদী
এনেছে স্রোতের মতো,আমি তার খুঁজিনি কিছুই।
কিছুই খুঁজিনি আমি,যতবার এসেছে এতীরে
নীরব তৃপ্তির জন্য আনমনে বসে থেকে পাড়ে
নির্মল বাতাস টেনে বহুক্ষণ ভরেছি এ বুক।”
আমাদের ব্যক্তিগত কিংবা জাতীয় জীবনে গ্রামের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এই গ্রামের প্রাকৃতিক কোন অংশের পরিবর্তন যুক্তিযুক্ত নয়। তাই আসুন আমদের স্ব স্ব অবস্থান হতে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হই। এটাই আজ সবার কাছে মিনতি রইলো।
লেখক পরিচিতি- ফারজানা আক্তার লিমা ছতুরা শরীফ, আখাউড়া, ব্রাক্ষণবাড়িয়া। ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।