আশুরার নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে আমাদের সমাজে কিছু কুসংস্কারের দৃশ্য। কানে বেজে ওঠে ঢাকঢোল পিটিয়ে গায়ে শিকল ঘণ্টি বেঁধে তাযিয়ার ইয়্যা হোসেন ইয়্যা হোসেন গাওয়া মিছিলের শোক ধ্বনি। আর সজ্ঞানে নিজের শরীর নিজে ক্ষতবিক্ষত করার কাণ্ড-জ্ঞানহীন লোকদের সার্কাস!
এ-ই কি আশুরা? এভাবেই কি মুহাররম মাসের সম্মান রক্ষা করা হয়? তারা কজন আশুরার রোজা রাখেন যারা এসব অসহ্য, অহেতুক, দৃষ্টিকটু কার্যক্রম করেন?
আমরা আজ শুনব অন্য এক আশুরার কথা। প্রকৃত আশুরা কিভাবে পালন করতে হয়, কী করণীয়, বর্জনীয়; মোটাদাগে দু-তিনটে কথা শুনব আজ।
পৃথিবীর সূচনালগ্নেই আল্লাহ তাআলা বারোটি মাস নির্ধারণ করে দেন। তন্মধ্যে চারটি মাস করেছেন সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ। তাই প্রাচীনকাল থেকেই আরব বিশ্বে উক্ত চারটি মাসকে পবিত্র মাস হিসেবে পালন করে আসছে। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, নিশ্চয়ই (ওইদিন থেকে) আল্লাহর কিতাবে তাঁর কাছে মাসগুলোর সংখ্যা হচ্ছে বারো। যেদিন তিনি আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর (বারো মাসের) মধ্যে চারটি হল পবিত্র। আর এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (সুরা তাওবা-৩৬)
হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে পাওয়া যায় ওই পবিত্র মাস চারটি হল, জিলকদ, জিলহজ, মুহাররম ও রজব। (বুখারি-মুসলিম)
আর এ মাসগুলোতে প্রাচীনকাল থেকে আবর বিশ্বে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী যুদ্ধ থেকে শুরু করে হানাহানি-মারামারি-লুটপাট ইত্যাদি কাজ থেকে বিরত থাকা হয়।
সম্মানিত মাসের মধ্যে অন্যতম হল, মুহাররম। মুহাররম অর্থই হল, সম্মান, মর্যাদাপূর্ণ। আর মুহাররমের ১০ তারিখে পৃথিবীর ইতিহাসে যেমন ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে ঠিক তেমনি ঘটেছে মর্যাদাপূর্ণ হৃদয়বিদায়ক ঘটনাবলীও।
আর মুহাররমের দশ তারিখকে আশুরা বলা হয়। কারণ, আশুরা আরবি শব্দ আশারা থেকে নির্গত। যার সহজ বাংলা দাঁড়ায়, দশ। তথা দশ মুহাররম।
আশুরা দিনের আমল ও করণীয়ঃ
এ দিনের তথা মুহাররমের দশ তারিখের ব্যাপারে অনেক মর্যাদা ও পুরস্কারে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যেমন, এদিনে রোজা রাখার কারণে বিগত বছরের গুনাহ মাপ করে দেওয়া হবে। এটাও বলা হয়েছে, রমজানের রোজার পর আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম রোজা হল মুহাররমের তথা আশুরার রোজা।
যেমনটা হজরত আয়শা রা. থেকে শুরু করে হজরত আবু হুরায়রা রা. সহ বেশ কিছু সাহাবিদের থেকে প্রমানিত।
সবচেয়ে মূল্যবান কথা হল,
এদিনে হজরত মুহাম্মদ সা. নিজে রোজা রেখেছেন এবং সাহাবিদেরকেও এদিনে ও এর আগে পরে একটি রোজা বৃদ্ধি করে রাখতে বলেছেন। যাতে ইহুদিদের সাথে সামঞ্জস্য না হয়। (কারণ তারাও এদিনে রোজা রাখত।) তথা মুহাররমের নয় দশ বা দশ এগারো তারিখে রোজার রাখার কথা বলা হয়েছে।
এদিনে রোজা রাখার পাশাপাশি অন্যান্য আমলও বেশি বেশি করতে পারি আমরা। হাদিসে এমনও বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে নিজ পরিবারে ভালো খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়োজন করবে (সামর্থ্য অনুযায়ী) আল্লাহ ত ‘আলা সারা বছর তার রোজগারে বরকত দেবেন।
এদিনে কুরআন তিলাওয়াত, দুআ-দুরুদ ইত্যাদি আমলও বেশি-বেশি করা যায়। এগুলো যে এদিনই করতে হবে এমন নয়। কিন্তু করলে তো লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। আল্লাহ তা’আলা তো দিতেই চান। তাঁর ভান্ডারে তো অভাব নেই।
আশুরা নিয়ে কুসংস্কার ও ভুল ধারণা।
মুহাররম মাস শুরু হবার আগ থেকেই দেখা যায় আশুরাকে স্বাগতম জানানোর জন্য কিছু সংখ্যক লোক ঢাকঢোল পিটিয়ে শহরের অলিগলি হয়ে হাইওয়েতেও লোকসমাগম করেন। আর আশুরার দিনে দলবেঁধে ইয়্যা হোসেন ইয়্যা হোসেন বলে লোক দেখানোর জন্য মাইকিং মেরে রাস্তঘাট বন্ধ করে তারা তাযিয়ার মিছিল বের করে শোক পালন করেন। আবার কেউ নিজের শরীরকে বিষাক্ত অস্ত্র দ্বারা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেন ওই লোকসমাগমেই। আরও বিভিন্ন অহেতুক কাণ্ড-জ্ঞানহীন কাজ করে থাকেন তারা। আর তা দেখার জন্য উৎসুক মানুষের উপচে পড়া ভীড়। যেনো সার্কাস!
তাদের এ কাণ্ড-জ্ঞানহীন কাজ কি আদৌ শোক পালনের (তারা কারবালার ময়দানে হজরত হুসাইন রা. এর শাহাদাতের জন্য শোক পালন করেন এ দিনে।) জন্য যথার্থ?
শিয়া সম্প্রদায় নেপথ্যে আশুরার দিনে তাযিয়ার মিছিল, গানবাজনা, এমন কি শিরক কুফুরির মতো জঘন্যতম কাজও কিছু মানুষ দ্বারা করায় ও করিয়ে যাচ্ছে। যা আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত। যেগুলো নিঃসন্দেহে আশুরার ও ইসলামের পরিপন্থী।
আমরা আশুরা মানে কী বুঝি?
আমরা আশুরা মানে বুঝি, হিজরির ৬১ সনে মুহাররমের দশ তারিখে হজরত মুহাম্মদ সা. এর প্রিয় নাতি হজরত হুসাইন রা. কারবালার ময়দানে শাহাদাতবরণ করেন। আর এ শাহাদাতের কারণেই এই আশুরার দিন এতো সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ।
কিন্তু এ ধারণা নিতান্তই ভুল। কারণ, হুজুর সা. এর জীবদ্দশায় আল্লাহ তা’আলা তার ওপর আয়াত নাযিল করে এদিনকে তথা মুহাররমের দশ তারিখকে সম্মানিত করেছেন। হুজুর সা. নিজেও আশুরার রোজা রেখেছেন। আর কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে হুজুর সা. এর বহু বছর পরে। (সম্ভবত তাঁর ইনতেকালের ষাট বছর পর)
এ আশুরার দিনে হুজুর সা. এর পূর্বের নবীগণ ও তাদের উম্মতের ওপর বেশকিছু ঐতিহাসিক আনন্দময়, মর্মান্তিক ও মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।
যেমন,
১, এদিনে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেন ও কেয়ামত সংঘটিত করবেন।
২, এদিনে মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম আ. কে সৃষ্টি করেন। হজরত আদম ও হাওয়া আ. কে দুনিয়াতে প্রেরণ এবং আরাফার ময়দানে তাদের পুনরায় সাক্ষাৎ ও তাদের দুআ আল্লাহ তাআলা কবুল এদিনই করেন।
৩, হজরত নুহ আ. এর কিস্তি এদিনই মহা প্লাবন থেকে জুদি নামক পাহাড়ে অবতরণ করেন।
৪, হজরত ইবরাহিম আ. নমরুদের অগ্নিকান্ডে নিক্ষিপ্ত হবার চল্লিশদিন পর এদিনই আল্লাহ তা’আলা তাকে মুক্তিদান করেন।
৫, হজরত আইয়ুব আ. আঠারো বছর এক কঠিন রোগে ভোগে এদিনই তিনি আরোগ্য লাভ করেন।
৬, হজরত ইউসুফ আ. চল্লিশ বছর পর পিতা হজরত ইয়াকুব আ. এর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ লাভ করেন।
৭, হজরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে চল্লিশদিন পর এদিনই মুক্ত হন।
৮, এদিনই হজরত মুসা আ. ও তার উম্মত বনি ইসরাইলদের আল্লাহ তা’আলা কাফের ফেরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি দেন এবং ফেরআউন ও তার দলবলকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে মারেন।
৯, হজরত ঈসা আ. এর জন্ম ও তাকে আল্লাহ তা’আলা আসমানে উঠিয়ে নেন এদিনই।
১০, এদিনই সর্বপ্রথম পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ পরানো হয়।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এবং তা সূর্যের মত সত্য।
মোদ্দাকথা হল,
মুহাররম আসলেই ঢাকঢোল না পিটিয়ে, তাযিয়ার মিছিন না বের করে, নিজ শরীরকে অহেতুক ছিন্নবিচ্ছিন্ন না করে, আমরা আশুরার দুটি রোজা রাখতে পারি। এবং এদিনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার কাছে আমরা আমাদের গুনাহ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রার্থণা করতে পারি। এবং এটাই আমাদের জন্য শ্রেয়।
লেখক পরিচিতি মুহিব্বুল্লাহ কাফি বাউনিয়াবাঁধ, পল্লবী, মিরপুর-১১ মোবাইলঃ 01830017196