ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রোজা। কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রোজা ফরজ করেছেন। এই ফরজ রোজা আদায়ের জন্য যে মাস নির্ধারণ করেছেন সেটি হলো রামাদান বা রমজান মাস। রামাদান বা রমজান শব্দটা এসেছে আরবি মূল রামিদা বা আর রামাদ থেকে, যার অর্থ প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। ইসলামিক বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে রমজান নবম মাস। এই মাসেই বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা রোজা পালন করে থাকেন।
অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে ইবাদতের সওয়াব বহুগুণ বেশি। হযরত মুহাম্মাদ (সা:) ৬১০ সালের রমজান মাসেই প্রথম ওহী পেয়ে নবী হয়েছিলেন। এই মাসেই পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছিল। কুরআন নাজিলের রাতকে বলা হয় লাইলাতুল কদর। এই রাতে ইবাদত করলে হাজার মাসের ইবাদতের থেকে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
রোজা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দিন’। আরবিতে এর নাম সাওম বা সিয়াম। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সঙ্গে যাবতীয় ভোগ-বিলাস, পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার নাম রোজা।
ইসলামি বিধান অনুসারে প্রতিটি সুস্থ সবল মুসলমানের জন্য রমজান মাসের রোজা রাখা ফরজ। বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। আর কাফফারা আদায়ের তিনটি বিধান রয়েছে, একটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে, যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে ও গোলাম বা দাসী আজাদ করে দিতে হবে।
সকল উম্মতের উপরই রোজা ফরয ছিল। যদিও রোজার সংখ্যা, ধরন ও অন্যান্য গুণাবলীর দিক বিবেচনায় পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। ’‘সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩’। এখানে পূর্ববর্তীদের বলতে হজরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে হজরত ঈসা (আ:) পর্যন্ত সব যুগের মানুষকে বোঝানো হয়েছে।
পবিত্র কুরআনুল কারিম দ্বারা প্রমাণ আছে যে হজরত আদম (আ:) থেকে রাসূল (সা:) পর্যন্ত সকল নবির শরিয়তের রোজা পালনের বিধান ছিল। আদম (আ:)-এর যুগে প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার বিধান ছিল। হজরত দাউদ (আ:) একদিন পর একদিন রোজা রাখতেন। হজরত মুসা (আ.) তুর পর্বতে ৪০ দিন রোজা রেখেছেন। হজরত দানিয়াল (আ:) একাধারে তিন সপ্তাহ রোজা রেখেছেন। হজরত মারইয়াম (আ:)-এর ব্যাপারে কুরআনে আছে, ‘আপনি বলুন, আমি আল্লাহর জন্য রোজা পালন করছি, আজ আমি কারও সঙ্গে কথা বলব না। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২৬)।
তবে যখন হযরত মুহাম্মাদ (সা:) এবং সাহাবীরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন তার পর থেকে পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয়। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন চলছিল আরবি শাবান মাস।
এ সময় এ আয়াত নাজিল হয়, রমাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হিদায়তের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। সূরা বাকারা : ১৮৫।
রাসূলুল্লাহ (সা:) মদিনায় হিজরত করার পর হিজরি দ্বিতীয় সনে রোজা ফরজ হওয়ার আগ পর্যন্ত দু’ধরনের রোজার প্রচলন ছিল। ১. আইয়ামুল বিজ অর্থাৎ প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখা। ২. আশুরার দিন অর্থাৎ ১০ মহররমের দিন রোজা রাখা। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্বাস (রা:) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আগে রোজা ছিল এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যা পর্যন্ত। রাতে ঘুমানোর পরে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করা বৈধ ছিল না।
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে বলেন, হিজরি দ্বিতীয় সনে শাবান মাসে বদর যুদ্ধের আগে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়।