দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনামের দাপ্তরিক নাম হলো রিপাবলিক অব সুরিনাম। দেশটির উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর, পূর্বে ফ্রেঞ্জ গায়ানা, পশ্চিমে গায়ানা এবং দক্ষিণে ব্রাজিল অবিস্থত। সুরিনামের মোট আয়তন এক লাখ ৬৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। এটি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষুদ্র আয়তনের সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখানে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৯৯০ জন জনসংখ্যা। যাদের বেশির ভাগ বসবাস করে উত্তর উপকূলে অবস্থিত দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী পারমারিবো ও তার আশপাশে। জনসংখ্যার ১৪.৩ শতাংশ মুসলিম। মুসলিমরা দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠী।
জনসংখ্যায় মুসলিমদের চেয়ে এগিয়ে থাকা অপর দুটি সম্প্রদায় হলো খ্রিস্টান (৫২.৩ শতাংশ) এবং হিন্দু (১৮.৮ শতাংশ)। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুরিনামের প্রধান আয়ের উৎস বক্সাইট, গোল্ড, পেট্রোলিয়াম ও কৃষি পণ্য। দেশটিতে বিস্তৃত প্রাকৃতিক বনভূমি আছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র সুরিনামেই সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস।
ধারণা করা হয়, সুরিনামে খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে মানব বসতি গড়ে ওঠে। ১৬৬০ থেকে ১৬৬৭ সালের মধ্যে সুরিনামে ডাচ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত ডাচ ঔপনিবেশিক শাসকদের মাধ্যমেই সুরিনামে মুসলিম আগমন ঘটে। ডাচ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর সুরিনামে শ্রমিক হিসেবে আফ্রিকান দাসদের নিয়ে আসা হয়, যাদের বিপুলসংখ্যক ছিল মুসলিম। যদিও দাসদের কোনো ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না এবং তাদের বৃহদাংশকে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়।
১৮৭৩ সালে এই উপকূলীয় রাষ্ট্রে বন্দি ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে আসা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্র ধরে সুরিনামে বিপুলসংখ্যক ইন্দোনেশিয়ান মুসলমানের আগমন ঘটে যারা ১৯০২ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে সুরিনামে আগমন করে এবং কৃষিকাজে স্থির হয়। বর্তমান সুরিনামের মুসলিম জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ান, ৩০ শতাংশ ভারতীয় এবং অন্য আফ্রিকার ধর্মান্তরিত মুসলিম। এ ছাড়া সুরিনামে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশের মুসলিম অভিবাসী শ্রমিক আছে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সহনশীলতার জন্য সুরিনাম বিখ্যাত। সেখানে সকল ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মপালন ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ পায়। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। ১৯৭৫ সালে নেদারল্যান্ডস থেকে স্বাধীনতা লাভের আগে সুরিনামের মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২৫ শতাংশের বেশি। স্বাধীনতার সময় নেদারল্যান্ডস নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিলে প্রায় দুই লাখ সুরিনামিজ দেশত্যাগ করে। এ সময় বহু মুসলিমও দেশত্যাগ করে। মুসলিমদের দেশত্যাগের ধারা এখনো অব্যাহত আছে। পিউ ফোরামের বর্ণনামতে ২০৫০ সালে সুরিনামের মুসলিম জনসংখ্যার ১১.৮ শতাংশে নেমে যাবে।
সুরিনামে দেড় শতাধিক সরকার অনুমোদিত মসজিদ ও একাধিক মুসলিম সামাজিক, দাতব্য ও ধর্মীয় সংগঠন রয়েছে। সুরিনামের বেশির ভাগ মুসলিম হলো সুন্নি মতাদর্শী এবং তারা হানাফি ও শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী। মুসলিমরা প্রধান সরকারি ভাষা ডাচের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে আরবি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করেন। ১৯৮০ সালে রাজধানী পারমারিবোর প্রাণকেন্দ্রে দেশটির সর্ববৃহৎ মসজিদ উদ্বোধন করা হয়। কায়জারস্ট্রাট মসজিদের আছে চারটি ৩০ মিটার মিনার। এতে প্রায় এক হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে।
সুরিনাম দেশটির রাষ্ট্র স্বীকৃত সাতটি ধর্মের একটি ইসলাম। ১৯৭০ সাল থেকে ঈদুল ফিতরে মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ছুটি উদ্যাপন করছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও সুরিনামের মুসলিমরা ধর্মীয় শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে। দেশটির মুসলিম জনসংখ্যার মাত্র তিন ভাগ আরবি বলতে বা পড়তে পারে। সুরিনামে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে পাকিস্তানি ও ইন্দোনেশিয়ান মুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।