● শনিবার, এপ্রিল 27, 2024 | 01:24 পূর্বাহ্ন

দামেস্ক-মদীনা রেললাইন

দামেস্ক – মদিনা রেলপথ

সুলতান ২য় আবদুল হামিদের আত্মনির্ভরশীলতার এক অনন্য নজির

১৯০৮ সালের ২৮ আগস্ট। এদিন প্রথমবারের মত সৌদি আরবের মদীনায় ট্রেন এসে থামে সুদূর সিরিয়ার দামেস্ক থেকে। এর ফলে শাম ও তুরস্কের মুসলমানরা নিরাপদে হজ্ব করার সুযোগ লাভ করে, যা আগে ছিল না।
.
১৯০০ সালের ১ মার্চ সুলতান ২য় আব্দুল হামিদ এই দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণের আদেশ প্রদান করেন। তখন দামেস্ক থেকে মদিনায় যেতে প্রায় ৪০ দিনের মত সময় লেগে যেত। সেই সাথে যাত্রাপথে হাজিদের লুটেরা, প্রতিকূল আবহাওয়াসহ নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হত।

১৯০৮ সালে হেজাজ রেল ষ্টেশন


.
১৯০৮ সালে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথের কাজ শেষ হয়। যদিও মক্কা পর্যন্ত এই রেলপথ স্থাপন করার কথা থাকলেও ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে লাইন তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৯ বছর এই রেলপথের মাধ্যমে হাজারো হাজি ও অসংখ্য সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছে। ১ম বিশ্বযুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময় আরবদের বিদ্রোহের ফলে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেক জায়গায় লাইন উপড়ে ফেলা হয়।


সব থেকেবিস্ময়ের বিষয় হলো, এই রেলপথ তৈরি করতে সুলতান কোন বিদেশি সাহায্য নেননি। বরং তার ইচ্ছে ছিল যে মুসলমানদের অর্থ ও শ্রমের মাধ্যমেই এই রেলপথ তৈরি হবে।
সেসময় সুলতানের এমন উদ্যোগে ইউরোপ জুড়ে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে। কারণ তখন অটোমান সালতানাতের অবস্থা ছিল খুবই দূর্বল। আর অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল খুবই নাজুক। আর উঁচু – নিচু মরূভূমির মাঝে এমন রেললাইন তৈরি করাও অনেক কঠিন কাজ ছিল।

দামেস্ক-মদীনা রেললাইন প্রস্তুত করণ


.
ইউরোপে তখন সুলতানের এই উদ্যোগকে বিলাসী কল্পনা হিসাবে প্রচার করা হচ্ছিল। সেইসাথে পত্র পত্রিকায় এই নিয়ে অনেক বিদ্রুপাত্মক লেখাও ছাপা হচ্ছিল। কিন্তু সুলতান তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি তার মনোবল ও স্পৃহা বিন্দুমাত্রও কমতে দেন নি।
এই রেলপথের কাজ করেন বিখ্যাত অটোমান প্রকৌশলী মোখতার বেহ, তিনি এর নকশা প্রনয়ণ করেন। প্রাচীন কালের উটের কাফেলার রূট অনুযায়ী তিনি এই নকশা তৈরি করেন।
.
এই রেললাইন তৈরির জন্য উসমানী বাজেটের ১৮ শতাংশ বেই বরাদ্দ দেওয়া হয়।৩ লাখ ২০ হাজার মুদ্রা সুলতান তার নিজস্ব তহবিল থেকে দান করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানদের দান আসতে থাকে এই রেলপথ তৈরির জন্য।
.
৫ হাজারের বেশি শ্রমিক এই রেললাইন তৈরির জন্য দিন রাত কাজ করে। এদের বেশির ভাগ উসমানী সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল। এই রেললাইন এর জন্য ইস্তাম্বুলে একটি রেল গবেষণা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়।
রেললাইন তৈরির সময় রেললাইন কে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রায় ২ হাজার সেতু তৈরি করা হয় বিভিন্ন স্থানে। প্রতি ২০ কিলোমিটার পরপর রেল স্টেশন স্থাপন করা হয়। এই সকল স্টেশনে যাত্রিছাউনির পাশাপাশি পানির ট্যাংক ও তৈরি করা হয়। উসমানি সাম্রাজ্যের মুসলমানরা ছাড়াও অনেক দেশের মুসলমানরা এই রেলপথের কাজে অংশগ্রহণ করে। অনেক শ্রমিক মারা যায়। তাদের রেললাইন এর পাশেই কবর দেওয়া হয়।
রেললাইন স্থাপনের ফলে হাজিদের যাত্রা আরও সহজ হয়, সেইসাথে আরব এ উসমানী সৈন্যদের যাতায়াত ও সুবিধাজনক হয়। ২ মাসের সফর পরিণত হয় ৪ দিনের সফরে! রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, ইরাক ও ইরান থেকে হাজার হাজার হাজিরা হজ্বের উদ্দেশ্যে সিরিয়া হয়ে এই রেলপথে যাত্রা করেন। ১৯১২ সালের মধ্যে এই রেলপথে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার হাজি সফর করেন। ১৯১৪ সালের মধ্যে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩ লাখে!

দামেস্ক – মদীনা ট্রেন চলাচল


.
কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হলো এই যে, যার স্বপ্ন, সাহস, শ্রম ও উদ্যোগে এই অসাধ্য সাধিত হল, সেই মহান সুলতান ২য় আবদুল হামিদ এই রেললাইন এ চলমান ট্রেনে চড়ার সুযোগ পাননি।
১৯০৯ সালে তাকে পদচ্যুত করা হয় এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর যুব তুর্কীরা ক্ষমতায় এসে এই রেলপথের নাম পরিবর্তন করে হামিদিয়া-হেজাজ রেলওয়ে থেকে শুধু হেজাজ রেলওয়ে রাখে।

রেললাইনের ক্ষতিসাধন : ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগেও এই রেলপথে আরব বেদুইনরা প্রায়ই হামলা চালাতো। কারণ এটাকে তারা তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য হুমকি বলে মনে করতো। আর এর ফলে হাজিদের উপর তাদের কর্তৃত্বও হ্রাস পাচ্ছিল।কারণ হাজার বছর ধরে তারা বংশ পরম্পরায় হাজিদের পথ দেখিয়ে ও নিরাপত্তা দিয়ে আসছিল। আর এই রেললাইন এর উপর চূড়ান্ত হামলা হয় ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৬-১৮ সালে, যখন ব্রিটিশদের সাথে মিলে আরবরা অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ব্রিটিশ অফিসার টি.ই. লরেন্স এর নেতৃত্বে আরবরা ফয়সাল বিন হুসাইন এর সাথে মিলে এই রেলপথের উপর বোমা হামলা চালায়। বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়, সেই সাথে অনেক জায়গার অসংখ্য ব্রীজও ভেঙে ফেলা হয়।
.
‌‌রেলপথ এর বর্তমান অবস্থা : ১৯১৮ সালের পর আরবরা এই রেলপথ পুনরায় চালু করার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যান্ত্রিক ও অন্যান্য দক্ষতার অভাবে তা বেশিদিন টিকেনি। ১৯১৮ সালের পর মাত্র ২বার মদিনায় এই ট্রেন এসে পৌঁছেছিল।একবার ১৯১৯ আর একবার ১৯২৫ সালে। বর্তমানে সৌদি অংশে এই রেলপথ অচল থাকলেও দামেস্ক , প্যালেস্টাইন ও জর্ডান অংশে স্থানীয়ভাবে এই রেলওয়ে এখনও চালু আছে। যেমন-আম্মান টু দামেস্ক। এছাড়া জর্ডানের মা’ন এলাকার ফসফেট খনি থেকে আকাবা উপসাগর পর্যন্ত রেললাইন চালু আছে। এই রেললাইন এর একটি চটকদার ব্যাপার হচ্ছে এখানে এখনও প্রথম দিকের কিছু বগি ও ইঞ্জিন ব্যবহৃত হচ্ছে যা বাষ্প ও কয়লা চালিত। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ইঞ্জিনটি হচ্ছে ১৮৯৮ সালের যা জার্মানিতে তৈরিকৃত!
তথ্যসূত্র :
১. সুলতান কাহিনি, তামীম রায়হান ।২. আরব নিউজ।৩. ইলমফিড.কম।৪. এনসাক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা।

এই সম্পর্কিত আরও

আবুল কালাম
বিস্তারিত...
 আরবে ঈদের তারিখ ঘোষণা
বিস্তারিত...
813788_175
বিস্তারিত...
রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান
বিস্তারিত...
জান্নাতের ফুল
বিস্তারিত...
কাজী নজরুল ইসলাম
বিস্তারিত...