রাজশাহীর আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি ২০১১ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। কিছুদিন পর গ্রাম থেকে পুরো পরিবার নিয়ে এসে মিরপুরের একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। সে সময় তার বেতন ছিল ১৪ হাজার টাকা। তিনি সেই প্রতিষ্ঠানে টানা ১০ বছর চাকরি করছেন। এ সময়ের মধ্যে পরিবারের সদস্য সংখ্যাতো বেড়েছে তার সাথে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম সহ দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয়। সে সময় ১৪ হাজার টাকায় কোনোমতে চলতে পারলেও এখন বেতন বেড়ে ২২ হাজার টাকা কিন্তু তাতেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। আলমগীর হোসেন বলেন, মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতনের টাকা শেষ হয়ে যায়। পরের মাসে বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্যের কাছ থেকে ধার করে চলতে হয়।
মিরপুরের আরেক বাসিন্দা রেজাউল ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেন। অনেকের কাছে মনে হতে পারে ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে পরিবার নিয়ে হয়তো খুব ভালো ভাবেই দিন চলছে। কিন্তু না, বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের ৬ সদস্যকে নিয়ে ৩০ হাজার টাকার বেতনেও সংসার চালাতে কষ্ট হয় তার। রেজাউল জানান, প্রতি মাসে মায়ের জন্য ঔষুধ কিনতে হয়। ঔষুধের পেছনেই ২-৩ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এ ছাড়া বাসা ভাড়া বাবদই খরচ প্রায় ১৯ হাজার টাকা। আর বাজার সদাই, ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচসহ অন্যান্য ব্যয় তো রয়েছেই। এসব শুনে কেমন চলছে রেজাউলের সংসার তা সহজেই অনুমান করা যায়।
শুধু রেজাউল কিংবা আলমগীর নন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এখন অনেকেরই টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে নিম্ন এবং মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় কি প্রভাব পড়েছে- তার সহজেই অনুভব করা যায়। এমন পরিবার আছে যাদের মাছ-মাংস কিনে খাওয়ারও সামর্থ্য নেই। ভোজ্য তেল, চাল-ডালসহ বাজারের অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শুধু কম দামি সবজি খেয়ে দিন পার করছেন তারা।
রাবেয়া আক্তার নামে এক গার্মেন্টস কর্মী রাজধানীর ইব্রাহিমপুর এলাকায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘মাস গেলে যা বেতন পাই, কার সবই বাজার সদাই করতে শেষ হইয়া যায়। ৮ বছর ধইরা ঢাকায় থাহি। দিন যত যাইতাছে ততোই জিনিসপত্রের দাম বাড়তাছে। চাকরি করি ৩ বছর ধইরা। এই তিন বছরে সবকিছুর দাম ডাবল বাইড়া গেছে। তয় বেতন কিন্তু তেমন বাড়ে নাই। তহন ৮ হাজার টাহা ছিল, এহন হইছে সাড়ে ১০ হাজার। কিন্তু আগে ৮ হাজার টাহায় কোনোরকম সংসার চালাইতে পারলেও এহন সাড়ে ১০ হাজারেও তেমন চালাইতে পারি না। মাছ-মাংসের মুখতো দেহাই হয় না। সবজি কিইনা খামু সেইডার দামও বেশি। এহন আলুর দাম একটু কম আছে। আলু ভর্তা খাইতে পারি। কিন্তু ভর্তার লগে যে একটু ডাইল খামু তাও দাম বেশি। তেলের দামও ডাবল। রাবেয়া বলেন, বাজারে যহন যে সবজির দাম একটু কম সেইডাই কিনি। পোলাপানরে গরুর মাংস তো দূরের কথা দুই মাস ধইরা কোনো মাংসই খাওয়াইতে পারি নাই।’
দিন যত যাচ্ছে সবকিছুর দাম ততই বেড়ে যাচ্ছে। এক বছরের মধ্যেই বাজারের অনেক পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বিপরীতে মানুষের আয়-রোজগার তুলনামূলক আরও কমে গেছে। মহামারির ধাক্কায় অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে পথে বসেছে আবার অনেকে দারিদ্রতার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। অনেক পণ্যের দাম এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নের অনেক বিবরণ দেয়া হয়। কিন্তু এই সমস্যার কোনো স্বীকৃতি নেই। যেহেতু এই নিম্ন মধ্যবিত্ত বা করোনা মহামারি সময়ে নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই, সেহেতু এদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো প্রয়োজনও মনে করে না।
তিনি বলেন, এখন মানুষ যেহেতু কষ্টে আছে, তারা যে অসন্তোষ সেটা তো প্রকাশের মাধ্যম খুঁজে বের করতে হবে। নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছাতে হবে। সংবাদ মাধ্যমের বক্তব্য কিংবা আমাদের মতো বিশ্লেষকদের বক্তব্য এখন নীতি প্রণেতাদের ভেতরে কোনো দাগ কাটে না। উনারা এগুলোকে গ্রাহ্যের ভেতরে নেন না। সুতরাং মানুষের দুঃখ কষ্ট, তাদের অস্বস্তি, অসন্তোষের বিষয়টি পৌঁছানোর জন্য আরও কার্যকর মাধ্যম তাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।
কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিঃসন্দেহে মানুষ এখন অনেক সমস্যায় আছে। তাদের আয় বাড়ে না। কিন্তু ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম ঠিকই বাড়ছে। সরকারের উচিত মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ানো, তাদের আয় কীভাবে বাড়বে সেই ব্যবস্থা করা।
সরকারের হিসাব বলছে আমাদের গড় আয় নাকি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা স্বল্প আয়ের নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ তাদের আয় বাড়ছে বলে তো আমরা দেখতে পারছি না। তাই সরকারের উচিত মানুষের আয় রোজগার কীভাবে বাড়ানো যায় তার ব্যবস্থা করা। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা। তা না হলে সরকারের সব বড় বড় অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। কারণ, দেশের উন্নতি হচ্ছে এটা বললে তো আমি এতে সন্তুষ্ট থাকতে পারবো না। আমার জীবনমানের কি উন্নতি হচ্ছে সেটা আমাকে দেখতে হবে। মানুষের জীবনমানের উন্নতি না করে বড় বড় অট্টালিকা, ব্রিজ, রাস্তাঘাট করলে সেটা মানুষ শুধু দেখবে, কিন্তু তাদের তো কোনো লাভ হবে না।