● মঙ্গলবার, এপ্রিল 23, 2024 | 02:05 অপরাহ্ন

প্রিয় শিক্ষিকা

আমার প্রিয় শিক্ষিকা

শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তাকেই বলে শিক্ষক। শিক্ষকতা হচ্ছে অত্যন্ত মহৎ একটি পেশা। একজন শিক্ষক হচ্ছে একজন ছাত্রের জীবন গড়ার কারিগর। ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে মা-বাবার অবদান যেমন অনস্বীকার্য তেমনি শিক্ষা জীবনে শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। মা-বাবা আমাদেরকে জন্ম দিয়ে লালন পালন করেন। আর শিক্ষকগণ আমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই মা-বাবার পরেই হলো শিক্ষকের স্থান। আমার শিক্ষা জীবনের সকল শিক্ষককে আমি খুব ভালোবাসি।

কবির ভাষায় বলতে হয়, ”মানব শিশু জন্ম নিলেই মানুষ কি আর হয়? মানব শিশু মানুষ করে মোদের বিদ্যালয়।” ছাত্র জীবনে যারা আমাদের শিক্ষা দানের মাধ্যমে আলোর পথ দেখান তারাই আমাদের শিক্ষক। আর এ সকল শিক্ষকের মাঝে বিশেষ কিছু গুণের কারণে কোনো কোনো শিক্ষক আমাদের মনে আলাদাভাবে স্থান করে নেন। হয়ে ওঠেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রিয় মানুষ। আমারও তেমনি একজন প্রিয় শিক্ষিকা আছেন।

আজ আমি কলেজে পড়ি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত আমি অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করেছি। সকলের মধ্যে আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন আফরোজা বেগম ম্যাম। তিনি সব সময় ছাত্রদের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করতেন, পড়াশোনায় বন্ধুর মতো সাহায্য করতেন। আমি তার সাহচর্যে মাত্র ২ বছর থাকার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু এই ২ বছরে তার পড়ানোর ধরন, চলাফেরা, গুণাবলি সব কিছুই আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর সততা, নিষ্ঠা এবং ব্যক্তিত্ব তাকে আমার কাছে একজন আদর্শ শিক্ষিকা হিসেবে তুলে ধরেছে।

তিনি বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। আমি ২০১২ সালে ওই বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন তিনি আমাদের শাখার কোনো ক্লাস নিতেন না। ১ বছর পর বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন ৪র্থ শ্রেণিতে উঠলাম তখন গণিত ক্লাসে প্রথম তার দেখা পেলাম। তিনি ৪র্থ শ্রেণিতে আমাদের গণিত ক্লাস করাতেন। আমি তখনও তার নাম জানতাম না। প্রথম দিন বাংলা ক্লাস শেষে গণিত ক্লাসের সময় তিনি আমাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন। ছেলেদের সারিতে আমি ১ম বেঞ্চে বসায় তিনি সর্ব প্রথম আমার কাছেই আসলেন। কাছে এসে আমার নাম পরিচয় জানতে চাইলেন। সেই দিনই হয় তার সাথে আমার প্রথম কথা।

আমি ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাকে সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুলে যেতে হতো। তাই আমার মা খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করতো। একদিন নাস্তা বানাতে দেরি হওয়ায় আমি না খেয়েই স্কুলে চলে যাই। ম্যামের ক্লাস চলাকালীন আমার ক্ষুধায় মুখটা শুকনো ছিল। তাই দেখে ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করলো যে আমার কি হয়েছে। আমি বললাম ‘না ম্যাম কিছু হয়নি।’ হঠাৎ-ই ম্যাম বলে উঠলো ‘আজকে না খেয়ে এসেছিস তাই তো?’ আমি বললাম জি ম্যাম। তখন টিফিনের সময় ম্যাম তার কাছে থাকা খাবার থেকে অর্ধেক খাবারই আমাকে দিয়ে দিলো। আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম ম্যাম কিভাবে বুঝতে পারলো। আর ম্যামের এই বুঝতে পারাটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে তোলে।

তিনি কখনই ক্লাসে আমাদের সাথে বিশেষ করে আমার সাথে অযথা রাগারাগি করতেন না। অন্যায় ছাড়া কোনো শাস্তি দিতেন না। আবার মাঝে মাঝে কোনো অন্যায় করলেও শাস্তি না দিয়ে আদর করে বুঝিয়ে দিতেন। প্রয়োজন হলে শাসনও করতেন। তবে তার এই শাসন আমি কখনোই খারাপ ভাবে নিতাম না। তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী ছিল। তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় দৃঢ়তার ছাপ। কঠিণ কোমলে মিশে একাকার। এই মানুষটি টিফিনের সময় আমায় হাত ধরে নিয়ে গিয়ে কত যে টিফিন খাইয়েছেন তার হিসেব নেই। খাওয়ানোর সময় বার বার জিজ্ঞেস করতেন আর কিছু খাবো কিনা। কিন্তু স্কুলে আমাকে যতই আদর করত না কেন অন্যদেরকেও কখনো অন্য চোখে দেখতেন না। তিনি আমার কাছে একজন আলাদা মানুষ হিসেবে ফুঠে ওঠে ঠিক আমার মায়ের মতো। তার এই দ্বৈত সত্বাটি আমার ছোট্ট মনে দাগ কাটে। আর আস্তে আস্তে হয়ে উঠেন আমার প্রিয় শিক্ষিকা।

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন স্কুলের কয়েকজন ম্যাম এক অনুষ্ঠানে শাহাজাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যাচ্ছিলেন। কিন্তু এটা আমরা জানতাম না। যাওয়ার আগে তারা নিজেরা আলোচনা করছিলেন। তখন আমরা স্যারের ক্লাস করছিলাম। সেই স্যার ছিলেন স্কাউটেরও শিক্ষক। তার স্কাউটের ছাত্রদের নিয়ে একটা জায়গায় যাওয়া কথা। তার স্কাউটের একজন ছাত্র পরনে প্যান্টের সাথে বেল্ট পড়েনি। তখন স্যার আমার বেল্ট চেয়েছিলেন ওই ছাত্রকে দিবেন বলে। কিন্তু আমি আমার বেল্ট দিতে রাজি হচ্ছিলাম না। তাই স্যার আমাকে কয়েকটা থাপ্পর মেরেছিলেন। এখানে আমার তেমন কোনো দোষ না থাকায় আমার বন্ধুরা বললো প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে এই ব্যাপারটা বলতে। আমার বন্ধুরা আমাকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে গেল। তারপর সব কথা শুনলো। সেখানে আফরোজা ম্যামও উপস্থিত ছিলেন। সে প্রধান শিক্ষককে বললো যে, আমাকেও তাদের সাথে ওই অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে। আর তখন সব দিক দিয়ে আমার পারফরম্যান্স ভালো থাকার কারণে তারা আমাকে তাদের সাথে নিয়ে গেলো। সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে জ্ঞাণী-গুণী মানুষদের সাথে সারা দিন কাটানো সময়টা আমার স্মৃতির পাতায় রয়ে গেছে এবং আজও আমার মনে পড়ে। এই সুযোগটা পেয়েছিলাম আফরোজা ম্যাম বলার কারণেই।

যাদের শ্রদ্ধা করে মন আনন্দিত হয়, তারা হলেন শিক্ষক। পৃথিবীতে মা-বাবার পর যদি কেউ ভালো চায় সে হলো আমার প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ। একজন শিক্ষক, শুধু শিক্ষকতা করলেই আদর্শ শিক্ষক হয় না। শিক্ষক হতে গেলে আদর্শ লাগে, অন্যান্য গুণাবলী লাগে, লাগে শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসা। যা তার কাছে ছিল। আমাদের প্রত্যেকের বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক থাকেন। তারা সকলে আমাদের শিক্ষাদানের মধ্যে দিয়ে জীবনে সঠিক পথে চলার সহায়তা ভূমিকা রাখেন। তার মধ্যে তিনি একজন। এছাড়া আমার আরেকজন অন্যতম প্রিয় শিক্ষিকা হলেন বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাসিনা আক্তার হাসি ম্যাম। তিনিও সারা জীবন আমারে হৃদয়ের গভীরে থাকবেন। এখন আর তাদের দেখা মেলে না। আজ দীর্ঘ দিন পর কলেজ লাইফেও এসে এমন একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা পেয়েছি যার ভিতরে আফরোজা ম্যাম, হাসি ম্যামকে দেখতে পাই। তিনি হলেন সাবিহা বেগম রোজ ম্যাম। যদিও সাবিহা ম্যামের ক্লাস করার তেমন সুযোগ পাইনি। কিন্তু তার ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসা, কথাবার্তার ধরন, ছাত্রদের সাথে সহজেই মিশে যাওয়া আমাকে মুগ্ধ করেন। সকল শিক্ষকই আমার কাছে, আমাদের কাছে সমান শ্রদ্ধেয়। যাদের ঋণ কখনো শোধ করা যাবে না। যাদের কখনো ভুলা যাবে না। সর্বোপরি তিনিই আমার জীবনের একজন প্রিয় শিক্ষিকা।

সেই বিদ্যালয়ে এখন আমি আর নেই। সেই ছোট্ট ক্লাস থেকে আজ কলেজ লাইফে যে কখন চলে আসলাম তা বুঝতেও পারিনি। তবে মনে পড়ে আফরোজা ম্যাম সহ সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। কিন্তু আমি মনে করি যতদিন সাবিহা ম্যামকে দেখবো ততদিন মনে হবে আফরোজা ম্যাম সহ আমার প্রিয় ব্যক্তিদের চোখের সামনে দেখছি। আল্লাহ তা’আলার কাছে দোয়া করি যেন তাদের আদর্শে জীবন গড়তে পারি। তিনি এখনো শিক্ষকতা করেন। তার কর্মস্থল বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় ঝড়ের কবলে পড়ে কালের গর্ভে হয়তো একদিন বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু এ জাতির জীবনে আফরোজা ম্যামদের মতো শিক্ষিকাদের খুব প্রয়োজন। আমার শ্রদ্ধার আসনে বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তর আমার আফরোজা ম্যাম।

শিক্ষা জাতির মেরদুন্ড। আর শিক্ষক হলো মূলমন্ত্র। তাকে একটি জাতির স্থপতি বলা হয়। শিক্ষিত সমাজ গড়তে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সমাজ থেকে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করেন। সকল শিক্ষক তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের খুব ভালোবাসেন। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জ্ঞান দেওয়ার জন্য তারা অবিরাম পরিশ্রম করেন। দিন-রাত শিক্ষাদানে খেটে যান। তাদের একমাত্র ভাবনা হচ্ছে কিভাবে একটি ভালো জাতি তৈরি করা যায়। তারা কখনো অর্থের পেছনে ছুটে না। তারা হলেন দেশের জন্য সম্পদ স্বরূপ।

এই সম্পর্কিত আরও

আবুল কালাম
বিস্তারিত...
 আরবে ঈদের তারিখ ঘোষণা
বিস্তারিত...
813788_175
বিস্তারিত...
রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান
বিস্তারিত...
জান্নাতের ফুল
বিস্তারিত...
কাজী নজরুল ইসলাম
বিস্তারিত...